প্রকাশিত: Sun, Jun 30, 2024 2:54 PM
আপডেট: Wed, Apr 30, 2025 12:07 AM

মৌলবাদ উৎপাদন বন্ধ করতে

মজিব রহমান : সাপের ডিম থেকে দোয়েল পাখি আশা করতে পারি না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভয়ানকভাবেই একেকটা শিক্ষার্থীকে মৌলবাদী মূর্খে পরিণত করছে। তারা হয়ে উঠছে তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক। কেন? সভ্য দুনিয়া মিথ্যার বেশাতি থেকে মুক্ত হয়েছে। ফ্রান্স শিক্ষার্থীদের গৃহে পড়ানো নিষিদ্ধ করেছে। আমেরিকাসহ সভ্য দেশগুলোতে স্কুলে ধর্ম পড়ানো নিষিদ্ধ। বিজ্ঞানবিরোধী কিছু পড়ানো যায় না। সভ্যদেশে সবচেয়ে মেধাবীরাই শিক্ষকতা করে। আর আমাদের দেশে? পুরোটাই উল্টো। এদেশে মাধ্যমিক হয়ে উঠেছে কোথাও চাকরি না-পাওয়াদের আস্তানা। বাংলাদেশের বড় বড় স্কুলে আড়াই/তিন হাজার ছাত্রের বিপরীতে মাত্র ১৫/১৭ জন এমপিওভূক্ত শিক্ষক। বিপরীতে ৪০/৫০ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক থাকে। এমপিওভুক্তরা অধিকাংশই নিম্ন মেধার এবং খণ্ডকালীনরা ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা বা ইংরেজি ঠিকমতো পড়তেও পারে না। 

বিজ্ঞান-গণিত বুঝে এমন শিক্ষক আরো কম। খণ্ডকালীনদের মাসিক বেতন দেয় ২/১০ হাজার টাকা। একজন প্রাথমিক পাস দোকান কর্মচারীও এর চেয়ে বেশি বেতন পান। ফলে এখানে মিনিমাম যোগ্যতা নিয়েও কেউ আসেন না। তারা নিজেরাই ধর্মান্ধতায় নিমজ্জিত। ধর্মান্ধতা থেকে বের হতে হলে যে পরিমাণ জানাশোনা এবং বিকশিত মেধা দরকার তাতো এদের নেই। পাঠ্যবই মুখস্থ করা কিছু দুর্বল ছাত্র যারা অন্য কোনো বইও পড়েনি তারা কেন শিক্ষকতা করবে? পড়াশোনা না-জানারা কীভাবে শিক্ষক হয়ে বসতে পারে? তাই শিক্ষকরাই সাধারণত হয়ে থাকে অলৌকিক শক্তির পূজারী। এতো নিম্ন মেধার শিক্ষক দিয়ে সভ্য সমাজ গড়া যায় না।

এটা একটা মারাত্মক দুষ্টুচক্র। পরিবারে মৌলবাদী পিতা-মাতা জন্মের পরেই শিশুটিকে মৌলবাদী বানাতে বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠে। মৌলবাদী সমাজও তাকে বিকাশহীন করে রাখে। আমাদের সমাজে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার চর্চা নেই। মুক্তির পথ হতে পারতো হাই স্কুলগুলো। কিন্তু সেটা হয়ে উঠেছে মৌলবাদের আখড়া। মেধাহীনরা ওখানে কোন মেধাবীকে ঢুকতে বা টিকতে দেয় না। কমিটিগুলোও স্বল্প বা কুশিক্ষিতে ভরপুর। ওরা স্কুলকে বানাতে চায় ধর্মালয়। যে হিন্দু প্রতিষ্ঠাতা স্কুলে মন্দিরও বানায়নি সেখানেও ওরা, গড়ে তুলছে ইবাদতখানা। ওরা হাইস্কুল থেকে নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তী, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গান, আবৃত্তিসহ যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিতে পেরেছে। ওরা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে সরিয়ে দিতে পেরেছে।

আমরা দুই বছর আমাদের এলাকায় আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিলাম। আমার ও আব্দুর রহমানের বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা ও আমার প্রশিক্ষণ থাকায় সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। কিন্তু কতিপয় মূর্খ মৌলবাদী বিতর্ককে নাস্তিকতা আখ্যা দিয়ে প্রচারণা চালায়। ওরা মৌলবাদী, মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী একাকার হয়ে উঠে। ওদের মূল আপত্তি- আমাদের কর্মকাণ্ড ওদের অপকর্মে নাকি বিঘ্নতা তৈরি করে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে না পারলে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা বন্ধ হবে না। বাংলাদেশে মৌলবাদী হামলাগুলোতে দেখেছি, হামলার শিকার শিক্ষকগণ অপেক্ষাকৃত মেধাবী, ভাল শিক্ষক, প্রগতিমনা ও হিন্দু। হামলাকারীরা অধিকাংশই ছাত্র ও মুসলিম মৌলবাদী। স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মৌলবাদী চেতনার শিক্ষার্থীরা সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার কারণে প্রগতিমনা শিক্ষকদের উপর হামলা চালিয়েছে। স্কুলগুলো বিষধর সাপ হয়ে ডিম পেরে তা দিচ্ছি আর জন্ম দিচ্ছে বিষধর সাপ। আমরা ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে গানের পাখি জন্ম নিবে আশা করছি। 

তাই দাবি করছিÑ[১] মাধ্যমিকের শিক্ষক কাঠামো পরিবর্তন করে এমপিওভূক্ত শিক্ষক বাড়াতে হবে। মাধ্যমিকের শিক্ষদের বেতন বাড়াতে হবে। শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আরো বাড়াতে হবে। [২] বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে এবং অবৈজ্ঞানিক বিষয় পড়ানো বাদ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানবিক ও সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে। [৩] স্কুলে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হবে, পাঠ্য বইর বাইরে যাতে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বই পড়তে বাধ্য হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। লাইব্রেরিয়ানদের দিয়ে ক্লাস নেওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। অযোগ্য খণ্ডকালীনদের দিয়ে পাঠদান নিষিদ্ধ করতে হবে। খণ্ডকালীন শিক্ষক হওয়ার মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে এবং তা সরকারি কর্তৃপক্ষের কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। [৪] মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে আক্রমন ও লাঞ্ছিত করাকে বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। শিক্ষকদের বিজ্ঞানবিরোধী কথা বলা, যৌন হয়রানি করা ও দুর্নীতি করাকে অযোগ্যতা হিসেবে গণ্য করে বরখাস্ত করতে হবে। বিজ্ঞানবিরোধী ও যৌন হয়রাণীমূলক কথা বলা ছাড়া ক্লাসে শিক্ষকদের কথা বলাকে দায়মুক্তি দিতে হবে। স্কুলগুলোতে বিষধর সাপের ডিমে তা দেয়া বন্ধ করান। দেশও সভ্য ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। এজন্য শেষ সম্ভাবনা হিসেবে রয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানেই আমাদের মত প্রকাশ করতে হবে এবং রাষ্ট্রের উপর চাপ তৈরি করতে হবে যাতে তারা সভ্য সমাজ গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। যাতে জ্ঞানভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তচিন্তার জায়গা হয়ে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সমাজে অসংখ্য বিষয় নিয়ে চালিয়ে যেতে হবে বিতর্ক। যাতে সামাজিক ভাবাদর্শগুলোও বদলে দেয়া যায়। সবই নির্ভর করছে আমাদের কথা বলার উপর, আমাদের কর্মকাণ্ডের উপর। ২৯-৬-২৪। ফেসবুক থেকে